ভারতের প্রথম মহিলা ডাক্তার এবং নারী শিক্ষা বিকাশের এক অন্যতম পথিকঃ কাদম্বিনী গাঙ্গুলী

0
2263

ডাক্তার কাদম্বিনী গাঙ্গুলী, এই নামটির সাথে এখন প্রায় বেশীরভাগ বাঙালীই পরিচিত। এই পরিচিতির একমাত্র কারণ টেলিভিশন সিরিয়াল।বর্তমানে ডাক্তার কাদম্বিনী গাঙ্গুলীর জীবনের ওপর নির্ভর করে শুধুমাত্র একটি নয় দুটি সিরিয়াল এখন চলছে বাঙালীর অন্দরমহলে।কিন্তু তাকে নিয়ে কেন হচ্ছে এমন মাতামাতি? কে এই কাদম্বিনী গাঙ্গুলী?এইসব প্রশ্ন এখন মনের মধ্যে জাগা স্বাভাবিক।তাই আজ, অর্থাৎ ১৮ই জুলাই চলুন একটু জেনে নেওয়া যাক এই মহীয়সী নারীর একটুকরো জীবন ইতিহাস।

তখন চলছে ভারত জুড়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন।সেই সময়ে নারীদের অধিকার, নারীদের শিক্ষার কথা বলা তো দূরে থাক ভাবাও পাপ।পুরুষশাসিত সেই সমাজে মেয়েদের ঠাই ছিল শুধুমাত্র পর্দার পেছনে আর ছিল বাল্যবিবাহ এবং সতীদাহের মতো নিষ্ঠুর প্রথা।সেই সময়ে মহিলাদের জন্য বরাদ্দ ছিল শুধুমাত্র একটিই কাজ শিশু জন্ম দেওয়া ,তাকে লালনপালন করা এবং ঘরকন্যার কাজ সামলানো।নারীদের শিক্ষা ও মুক্তির কথা কল্পনাতেও জায়গা পেত না সেই সময়ে। ঠিক এমনই এক কঠিন সময়ে হয় তাঁর উত্তরণ, ভারতবর্ষের প্রথম বাঙালী মহিলা ডাক্তার কাদম্বিনী গাঙ্গুলী।

তৎকালীন সমাজের সমস্ত বাঁধা ভেঙে, পুরুষতন্ত্রের চোখ রাঙানি সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে তিনি ছিনিয়ে নিয়েছিলেন তাঁর মুক্তি, তাঁর শিক্ষার স্বাধীনতা আর হয়ে উঠেছিলেন বাঙলার নবজাগরণের এক অন্যতম মুখ। তিনিই ছিলেন ভারতের প্রথম স্নাতক ডিগ্রীধারী মহিলা এবং পরবর্তীতে তিনিই হয়ে উঠেছিলেন পুরো দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম মহিলা শল্য চিকিৎসক যার পাশ্চাত্য চিকিৎসা পদ্ধতি সম্বন্ধে ছিল অপার জ্ঞান।

কাদম্বিনী দেবীর জন্ম ও তাঁর বড়ো হওয়া

১৮৬১ সালের ১৮ই জুলাই ভাগলপুরে জন্ম হয় কাদম্বিনী দেবীর।তবে তাঁর বেড়ে ওঠার স্থান ছিল বরিশাল।তাঁর মধ্যে প্রথম নারী শিক্ষা ও স্বাধীনতার বীজ বপন করে দেন স্বয়ং তাঁর পিতা, ব্রজ কুমার বসু।যিনি তৎকালীন ব্রহ্ম সমাজের এক পরিচিতি মুখ ছিলেন।ব্রজ কুমার বাবু পেশায় ছিলেন একজন প্রধাণ শিক্ষক এবং মনেপ্রাণে ছিলেন একজন স্বাধীনচেতা মানুষ।কাদম্বিনী দেবীর শিক্ষা অর্জনের চাহিদাতে তাঁর পিতার ছিল পূর্ণ সমর্থন।

কাদম্বিনী দেবী তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা সম্পূর্ণ করেন বঙ্গ মহিলা বিদ্যালয় থেকে এবং পরবর্তীতে শিক্ষা লাভ করেন বেথুন স্কুল থেকে।বেথুন স্কুলের তিনিই প্রথম শিক্ষার্থী যিনি কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশিকা পরীক্ষায় বসেন এবং সসম্মানে উত্তীর্ণ হন উচ্চমহিলাতর শিক্ষার জন্য। ১৮৭৮ সালের ব্রিটিশ শাসিত ভারতে দুইজন মহিলা স্নাতকের মধ্যে একজন হলেন কাদম্বিনী গাঙ্গুলী।

কাদম্বিনী ও দ্বারকানাথ গাঙ্গুলী  

কাদম্বিনী গাঙ্গুলীর সাফল্যের পেছনে যিনি ছিলেন প্রধান কান্ডারী তিনি হলেন কাদম্বিনী দেবীর শিক্ষক ও পরবর্তীতে তাঁর স্বামী দ্বারকানাথ গাঙ্গুলী। দ্বারকানাথ গাঙ্গুলী ছিলেন ব্রাহ্ম সমাজের একজন বিশিষ্ট নেতা এবং নারী শিক্ষা ও স্বাধীনতার সংগ্রামের একনিষ্ঠ সংগ্রামী।কাদম্বিনী ও দ্বারকানাথের বিবাহের পর সকলে ভেবেছিলেন স্নাতক ডিগ্রীই হয়তো কাদম্বিনী দেবীর শিক্ষা পথের শেষ সোপান।সেই ভাবনাকে ভুল প্রমাণ করে দিয়ে দ্বারকানাথের উৎসাহে চিকিৎসা বিজ্ঞান নিয়ে উচ্চশিক্ষার উদ্দেশ্যে পা বাড়ালেন কাদম্বিনী দেবী। তবে এই পথ মোটেও সহজ ছিল না তাঁর জন্য। বিস্তর সমালোচনা ও কুকথার বাক্যবানে জর্জরিত হতে হয়েছিল তাঁকে। তবে সব পরিস্থিতিতেই তিনি সর্বদা পেয়েছিলেন তাঁর স্বামীর সমর্থন।

কাদম্বিনীর প্রথম মহিলা ডাক্তার হওয়ার ইতিহাস

আজ কাদম্বিনী দেবী সমস্ত নারীদের কাছে অনুপ্রেরণীয় কারণ তিনি ছিলেন ভারতবর্ষের প্রথম মহিলা ডাক্তার।কাদম্বিনীর ডাক্তারি শিক্ষার পথ কিন্তু মোটেই সহজ ছিল না।কাদম্বিনী দেবী যখন ডাক্তারী শিক্ষা লাভের উদ্দেশ্যে কোলকাতা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হতে যান তখন তাঁর অসাধারণ মেধা থাকা সত্ত্বেও কোলকাতা মেডিকেল কলেজ কতৃপক্ষ তাঁকে ভর্তি নিতে প্রত্যাখ্যান করে। কারণ সেইসময়ে কোনো নারীই আগে কখনোই পুরুষদের পাশে একসাথে বসে ডাক্তারি পড়তে যেতেন না।এরপর শুরু হল কোলকাতা মেডিকেল কলেজের সাথে কাদম্বিনী-দ্বারকানাথের আইনি লড়াই।অবশেষে জিত হল কাদম্বিনীদের এবং কাদম্বিনী পা বাড়ালেন তাঁর স্বপ্নপূরণের পথে।১৮৮৬ সাল বাঙলা তথা ভারতবর্ষের ইতিহাসের সেই ঐতিহাসিক বছর, যেই বছরে কাদম্বিনী দেবী পেলেন ডাক্তারি প্র্যাকটিসের অনুমতি পত্র এবং হয়ে উঠলেন ভারতের প্রথম বাঙালী মহিলা শল্য চিকিৎসক, যিনি পাশ্চাত্য চিকিৎসা বিদ্যায়ও সমান পারদর্শী।

সমাজসংস্কারক কাদম্বিনী দেবী  

কাদম্বিনী দেবী কিন্তু শুধুমাত্র নিজের স্বপ্নপূরণ করেই থেমে থাকেননি। সমাজের সমস্ত নারীরা যাতে তাঁর মতো স্বপ্নপূরণ করার সুযোগ পান এবং শিক্ষা অর্জনেরও যথাযথ সুবিধা পান তার জন্যও তিনি লড়ে গিয়েছিলেন বরাবর। প্রাচ্যের কয়লাখনির মহিলা শ্রমিকদের অবস্থার উন্নতির জন্য তার অসম্ভব লড়াই আজও ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা রয়েছে।কোলকাতা মেডিকেল কলেজের বিপক্ষে গিয়ে নারী শিক্ষার্থীদের ভর্তির উদ্দেশ্যে তার জ্বলন্ত বক্তৃতাই মেডিকেল কলেজে নারী শিক্ষার দরজা খুলে দিয়েছিল। শুধু এইটুকুই নয় নারী শিক্ষা ও স্বাধীনতার পেছনে তার সারাজীবনের অবদান কখনোই ভোলার নয়।

ডাক্তার কাদম্বিনী দেবীকে কয়েকটা শব্দে ব্যাখ্যা করা অসম্ভব।তিনি ছিলেন এক বিশাল মাপের ব্যক্তিত্ব, বড় মনের মানুষ। সমাজের জঘন্য প্রথাকে সাহসের সাথে গুড়িয়ে তার এই স্বপ্ন ছোঁয়ার ইতিহাস মোটেই সহজ ছিল না। তবে অসম্ভব শব্দটিও ছিল তাঁর অভিধানের বাইরে। তাই আজ এতবছর পরেও তিনি মানুষের মনে সগর্বে বিরাজমান।

আরও পড়ুনঃ পাব্লিক প্রভিডেন্ট ফান্ড অ্যাকাউন্ট কী?জেনে নিন PPF-এর সম্বন্ধে বিস্তারিত তথ্য!

Leave a Reply